আমরা এমন একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল সময় পার করছি যেখানে বিশ্ব প্রতিটি মুহূর্তে প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি নিত্য নতুন জটিল সমস্যার সাক্ষী হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রযুক্তিগত বিপ্লব পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের ধারণা, প্রস্তুতি ও কাজের ধরনকে। কালের প্ররিক্রমায় আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এ আই) যুগে প্রবেশ করেছি । মানুষের ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ধাপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগ ইতোমধ্যেই লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো প্রেডিক্টিভ পুলিশিং , যা স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নের অন্যতম উপাদান।
স্মার্ট পুলিশিং বলতে এমন এক ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে একটি স্বয়ংক্রিয়, দ্রুতগতি সম্পন্ন ও তুলনামূলক নির্ভুল ব্যবস্থাপনার উন্মেষ ঘটবে। অপরাধ ও অপরাধীকে সনাক্ত করার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ আই) অপরাধ প্রতিরোধ, বিশ্লেষণ ও প্রতিকারে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তথ্য সংগ্রহের বিভিন্ন উৎস যেমন সিসি ক্যামেরা , সেন্সর ডিভাইস , পূর্বে তৈরিকৃত ডাটাবেজের তথ্য বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ আই) তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। আইন প্রয়োগের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এ আই) সংযোজন একটি বৈপ্লবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে যা জননিরাপত্তায় ফোর্স মোবিলাইজেশন , রিসোর্স এলোকেশন, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অগ্রিম তথ্য প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের বড় সুবিধা হলো প্রেডিক্টিভ এনালাইসিস। সুবিস্তর তথ্য ভান্ডারের স্বয়ংক্রিয় পর্যালোচনার মাধ্যমে এ আই এলগোরিদম এমন কিছু ঘটনা ও অপরাদের লক্ষণ সনাক্ত করতে সক্ষম যা মানুষের পর্যালোচনা শক্তি দ্বারা অসম্ভব। এই পূর্ব সনাক্তকরণ সক্ষমতা পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কোনো অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পূর্বেই অপরাধ দমনে সাহায্য করবে। এই ক্ষেত্রে এ আই অপরাধীর আচরণ বিশ্লেষণ করে অপরাধ প্রবণ অঞ্চল, অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী রিসোর্স মোবিলাইজেশন ও প্রোএক্টিভ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্রিমিনাল ট্র্যাক ডাটা, মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সমাজের ৩০%-৪০% অপরাধ কমানো সম্ভব। একই সাথে জরুরি সময়ে সেবা প্রত্যাশীর ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় ২৫%-৩০% কমিয়ে আনে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মুখমন্ডল সনাক্তকরণ (ফেইস রিকগনিশন) প্রযুক্তি সন্দেহবাজন অপরাধীকে চিহ্নিত করতে ও তার গতিবিধি লক্ষ্য করতে সক্ষম। একই সাথে এই প্রযুক্তি নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান, আত্মগোপনে থাকা অপরাধীকে খুঁজে বের করা ও জনসমাগমে মানুষের নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অর্লিন্স শহরের পুলিশ অপরাধী, গাড়ি ও স্থান সনাক্ত করতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে। রাশিয়া ও চায়নাতেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত।
নিরাপদ ও উন্নত শহর বাস্তবায়নে স্মার্ট পুলিশিংয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয়, গতিশীল, নির্ভুল, নিরাপদ ও জনবান্ধব করার লক্ষ্যে বিশ্ব্যব্যাপী নানান প্রদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দি এ আই গ্লোবাল সার্ভেইল্যান্স (এআইজিএস) এর ২০১৯ এর তথ্যমতে ৫৬ টি দেশ ইতোমধ্যে নিরাপদ শহর গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছে। এ আই প্রযুক্তির সাহায্য শহরের রাস্তায় চলমান সকল গাড়ির তথ্য সংগ্রহ, ট্রাফিক ফ্লো সিমুলেশন, যানজটের পরিমাণ ও রুট ট্র্যাকিং পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব। যার ফলে জনসাধারণের যানজটের ভোগান্তি হ্রাস ও সময়-অর্থ সাশ্রয় হবে। একই সাথে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চলাচল , ফিটনেস বিহীন গাড়ি সনাক্তকরণ, যত্রতত্র পার্কিং , খেয়ালখুশিমতো রাস্তা পারাপার সহ সকল অসংলগ্ন ও আইন বহির্ভুত কার্যক্রম রোধ করা সম্ভব হবে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকনলপনার মাধ্যমে শহরের বাস্তবিক তথ্যের উপর একটি সুবৃহৎ ডাটা সেট তৈরী করার মাধ্যমে ভবিষ্যৎমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করবে।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে মানুষের ভার্চুয়াল কার্যক্রম ও নির্ভরতা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। যেহেতু সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি খুবই সংবেদনশীল তুলনামূলক নতুন তাই এই অপরাধ দমনে, প্রতিকারে ও জনসচেতনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এ আই প্রযুক্তি খুব দ্রুত অসঙ্গতি সনাক্ত করতে ও তড়িৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রতিহত করতে সক্ষম। এই প্রোএক্টিভ ব্যবস্থাপনা দেশের ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে স্বয়ংক্রিয় পাহারাদার হিসেবে কাজ করে। সাইবার সিকিউরিটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও উপযোগিতায় একে অপরের পরিপূরক।
অধিকন্তু, স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সুষ্ঠূ মানবসম্পদ ও সম্পদ বরাদ্ধ (রিসোর্স এলোকেশন ) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে পেট্রল রুটস অপটিমাইজেশন, লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা ও মাঠ প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় এ আই এলগোরিদম ডাটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎমুখী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এটি শুধু সেবা প্রদানে গতিশীলতাই আনে না বরং একই সাথে সেবার মানউন্নয়ন ও জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করে। ২০১৫ সালের দিকে ৮১ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান কোনো না কোনো ভাবে হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করতেন। পরবর্তীতে রিও দি জেনেরিওর পুলিশ হত্যার ঘটনা ও হুমকি পর্যালোচনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয় এবং উক্ত অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হোন।
আমাদের দেশের বিদ্যমান পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ বিশ্বের সকল জনবহুল দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনন্য উদহারণ স্থাপন করবে। স্বয়ংক্রিয় ও দ্রুত সনাক্তকরণ, সাড়াদান ও প্রতিকারের এই সক্ষমতা সামাজিকভাবে অপরাধ দমন ও বিস্তাররোধে সাহায্য করবে। একই সাথে ডাটা ড্রিভেন পর্যালোচনার মাধ্যমে এ আই প্রদত্ত ভবিষৎমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে যা একটি সুষ্ঠ , সুন্দর ও নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থার দিকে আমাদের নিয়ে যাবে।
লেখক
মহিউদ্দিন শিবলী
ত্রিমাত্রিক এআই